দুপুর ২টা ১০ মিনিটে (২৯ অক্টোবর) হঠাৎ করেই একসঙ্গে কমিশন ছাড়েন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার। এরপর চাউর হয় পুরো কমিশনের পদত্যাগের খবর। এদিন সকালেই পদত্যাগ করেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ, কমিশনার (তদন্ত) জহুরুল হক ও কমিশনার আছিয়া খাতুন (অনুসন্ধান)।গণমাধ্যমকে ফাঁকি দিতে হঠাৎ করে বেরিয়ে যান দুদক চেয়ারম্যান ও দুই কমিশনার। দুদক কমিশনার জহুরুল হক বের হন পেছনের লাল গেট দিয়ে। কমিশনার বের হওয়ার আগে নিচতলায় দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীনের রুমে যান। বিদায় নেন কয়েকজন কর্মকর্তার কাছ থেকে। দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ দায়িত্ব নেন ২০২১ সালের মার্চে। তার সঙ্গে নিয়োগ পান জহুরুল হক। এর দেড় বছর পর আছিয়া খাতুনকে কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খানের স্থলাভিষিক্ত করা হয়। পুরো কমিশনের পদত্যাগ করায় দুদকে শেষ হলো মঈনউদ্দীন অধ্যায়।
জানতে চাইলে মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দুপুরে পদত্যাগ করেছি। লোক মারফত পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে।’কী কারণে পদত্যাগ করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি জানি না।’ এরপর তিনি ফোন কেটে দেন। দুদক সচিব এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।দুদকের একটি সূত্র জানায়, দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনার তাদের পদত্যাগপত্র কমিশন অফিসে জমা দিয়েছেন। এ বিষয়ে দুদক সচিব এবং সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এক অনির্ধারিত বৈঠক করেছেন। বৈঠকের পর দুদক থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়েছে।দুপুরে পদত্যাগ করেছি। লোক মারফত পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে।
দুদক উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দুদক আইন ২০০৪ এর ১০ ধারা অনুযায়ী কমিশন রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দাখিল করেছেন।’৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। এরপর থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে। ব্যাপক রদবদল দেখে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা। দুদকের একাধিক সূত্রের দাবি, জুলাইয়ে পদত্যাগ করতে মনস্থির করেন দুই কমিশনার ও চেয়ারম্যান। তবে তারা পদত্যাগ করেননি। এরপরই দুদকের জালে ধরা পড়েন একের পর এক আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি ও আমলা।দলীয় সরকারের অধীনে নিষ্প্রভ থাকা দুদক হয়ে ওঠে সক্রিয়। গত তিন মাসে আওয়ামী লীগের দেড় শতাধিক মন্ত্রী, এমপি ও আমলার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।
কেমন ছিল মঈনউদ্দীন অধ্যায়?
গত ৩ অক্টোবর দুদক সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সোমবার বিকেলে দুদক কমিশনের সঙ্গে সংস্কার কমিশনের বৈঠক করার কথা ছিল, তার আগেই পুরো কমিশন পদত্যাগ করলো।২০২১ সালে দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রভাবশালীদের আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন মঈনুদ্দীন আবদুল্লাহ। তবে হয়েছে তার উল্টো। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি, ঘুস ও অর্থ পাচারের ঘটনা গণমাধ্যমে উঠে এলেও কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি দুদককে। অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও চুনোপুঁটি ধরতেই ব্যস্ত ছিল পুরো কমিশন। আর তাতে বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালে (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচকে নামতে থাকে বাংলাদেশের অবস্থান। ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম। ২০২৩ সালে তা ১০ম স্থানে নেমে যায়।২০২৩ সালে দুদক উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের বদলির ক্ষমতা দুদক চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের হাত থেকে সরিয়ে সচিবের হাতে ন্যস্ত করা হয়। ফলে খর্ব হয় কমিশনের ক্ষমতা। আমলাতন্ত্রের হাতে বোতল বন্দি হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দেয় খোদ কমিশনে।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিয়ে চাকরি হারান আলোচিত দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন।তাদের পদত্যাগ প্রত্যাশিত ছিল। যেহেতু তারা সরকারের নির্দেশনা অনুসরণ করে পদত্যাগ করেছেন, সেহেতু সরকারের নিশ্চয়ই চিন্তা-ভাবনা আছে নতুন কমিশন কীভাবে গঠন করা হবে।- দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান২০২৩ সালের মে মাসে বর্তমান অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মামলা দেয় মঈনুদ্দীন কমিশন। এ ঘটনায় অনেক সমালোচনার জন্ম দেয়। চলতি বছরের ১১ আগস্ট ওই মামলা প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত।
গুঞ্জন রয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মঈনুদ্দীন কমিশন প্রায় দুই শতাধিক আওয়ামী মন্ত্রী, এমপিকে দায়মুক্তি দিয়েছেন। একইভাবে ৫ আগস্টের পর অর্ধশতাধিক বিএনপির নেতাকর্মীকেও দেওয়া হয়েছে দায়মুক্তি।সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুদক কমিশন সাজাতে সার্চ কমিটি প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পদ শূন্য না হলে সার্চ কমিটি গঠন করা যায় না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আভাস পেয়েই তিন শীর্ষ কর্মকর্তা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। শিগগির সার্চ কমিটিও গঠন হতে পারে।। আগামী সপ্তাহের মধ্যেই নতুন কমিশন নিয়োগ হয়ে যাবে।
নতুন করে যারা আলোচনায়
দুদক, জনপ্রশাসন ও জুডিসিয়াল সার্ভিস সূত্রে জানা যায়, নতুন কমিশনে চেয়ারম্যান পদে সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল (অব.) ইকবাল করিম ভুঁইয়া, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব এ এইচ এম নুরুল ইসলাম ও ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর সাবেক বিচারক মোতাহার হোসেনের নাম শোনা যাচ্ছে।এ এইচ এম নুরুল ইসলামকে ২০০৪ সালের ৩ জুন বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। তার নামে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর সময় মামলাও দায়ের করা হয়। দুদক সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নথিপত্র তিনি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সিডি আকারে সংরক্ষণ করেছিলেন। এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তবে, পরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করে দুদক।মোতাহার হোসেন ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা বিদেশে অর্থপাচার সংক্রান্ত দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা করেন। কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় রায়ে তিনি তারেক রহমানকে বেকসুর খালাস দেন। মোতাহার হোসেনের বিরুদ্ধেও দুদকে অনুসন্ধান ছিল। পরে নিষ্পত্তি করা হয়।
দুই কমিশনার পদে দুদকের সাবেক মহাপরিচাক (ডিজি) প্রশাসন ক্যাডারের মুনীর চৌধুরী, জুডিসিয়াল সার্ভিসের মঈদুল ইসলাম, দুদকের নিজস্ব জনবলের আমীরুল আলম, ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক নুর আহমেদ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর নামও আলোচনা হচ্ছে। তাদের মধ্যে মুনীর চৌধুরীর বাড়ি চট্টগ্রাম বিভাগে। এছাড়া কমিশনের বিশেষ তদন্ত শাখার বর্তমান মহাপরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর বাড়িও চট্টগ্রাম।সূত্র জানায়, নতুন কমিশনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি ও জামায়াত তাদের পছন্দের লোক খুঁজছে। প্রশাসন ক্যাডারও তাদের প্রভাব ধরে রাখতে চায়। তারাও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে বাছাই করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জুডিশিয়াল সার্ভিসও নিজেদের পছন্দের লোককে দুদকে বসাতে চায়।জানতে চাইলে দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ও টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘তাদের পদত্যাগ প্রত্যাশিত ছিল। যেহেতু তারা সরকারের নির্দেশনা অনুসরণ করে পদত্যাগ করেছেন, সেহেতু সরকারের নিশ্চয়ই চিন্তা-ভাবনা আছে নতুন কমিশন কীভাবে গঠন করা হবে।’তিনি বলেন, ‘দলীয় প্রভাবমুক্তভাবে নিয়োগপ্রাপ্তরা কখনোই নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেনি। এখন যেহেতু অন্তবর্তী সরকার দায়িত্বে আছে, তাই আশা করবো অবশ্যই যথাযথ মানদণ্ড বজায় রেখে উপযুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেবেন।’